মাহবুব মোর্শেদ
বেশ কৌতূহল-উদ্দীপক খবর। `অনলাইন গণমাধ্যমে`র জন্য একটি নীতিমালা করতে যাচ্ছে সরকার। সময়সীমা অক্টোবর ২০১২। সেপ্টেম্বর মাসের ১২ তারিখে তথ্যসচিব অনলাইন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের ডেকে এতথ্য জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত নীতিমালা সরবরাহ করেছেন এবং তাদের মতামত জানতে চেয়েছেন। মত দেবার সময় ১০ দিন। একটি বিষয় স্পষ্ট যে, নীতিমালা প্রণয়নের ব্যাপারে সরকার একটি তাড়াহুড়ার মধ্যে আছে। প্রথম প্রশ্ন হলো, কেন এই তাড়াহুড়া?
আলোচনার সুবিধার্থে প্রস্তাবিত নীতিমালার লিংক (http://bit.ly/QftohR) এখানে দিলাম।
নীতিমালাটি পড়লে মনে বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়। সেসব প্রশ্নের আগে কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা দরকার।
অনলাইন গণমাধ্যমের সংজ্ঞায়ন
নীতিমালা যারা তৈরি করেছেন তাদের অনলাইন গণমাধ্যম সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। অনলাইন গণমাধ্যম সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা থাকলে প্রথম কাজ হিসেবে তারা অনলাইন গণমাধ্যম কী, তা স্পষ্ট করতেন। অনলাইন গণমাধ্যম খুব বিস্তৃত একটি ধারণা। যদি পেশাদার ও মূলধারার অনুসারী সংবাদ পরিবেশনের সাইট এবং দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশনের ওয়েবসাইটগুলোকে বিবেচনায় এনে অনলাইন গণমাধ্যম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হতো তবে সেটি একদিক থেকে যৌক্তিক হতে পারতো। কেননা, সংবাদ সংগ্রহ, প্রস্তুত ও পরিবেশনের ক্ষেত্রে এরা দক্ষ, প্রভাব বিস্তার ও মতামত তৈরিতে এদের বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা আছে। গঠনগত কারণেই এরা বড় পুঁজির ওপর নির্ভরশীল, বিদ্যমান বিজ্ঞাপন ও বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত।
কিন্তু যদি নির্দিষ্ট ধরনের সাইটকে চিহ্নিত না করে সরকারি কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সংজ্ঞা নির্ধারণের ভার ছেড়ে দেওয়া হয় তবে প্রয়োজন অনুসারে ব্যক্তিগত ও কমিউনিটি ব্লগ, ইউটিউব বা এ ধরনের অডিও-ভিডিও সাইট, টুইটারের মতো মাইক্রো ব্লগিং সাইট, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের সাইটকেও অনলাইন গণমাধ্যম হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া সম্ভব। ধরে নেওয়া যায়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনার ভয়ে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ব্লগস্পট, ওয়ার্ডপ্রেসের মতো সাইটের দিকে সরকার সহসা হাত বাড়াতে পারবে না। কিন্তু, ব্যক্তিগত ব্লগ, কমিউনিটি ব্লগ এবং সংবাদ ও মতামতভিত্তিক ব্লগগুলো সরকারের হয়রানির শিকার হবে।
বাংলাদেশে কমিউনিটি, বন্ধুদল ও গোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত বেশ কিছু নিউজ সাইট আছে। কিন্তু এগুলোর অধিকাংশই আকারে ছোট, অপেশাদার, ধারাবাহিকতাহীন। এদের পাঠক সংখ্যাও অপ্রতুল। গুণেমানে অনেক সাইটই উল্লেখযোগ্য নয়। তবে প্রতিভাবান তরুণ উদ্যোক্তাদের কোনো সাইটের বিশেষ সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সম্ভাবনা বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত এদের মূলধারার পেশাদার মিডিয়া হিসেবে গণ্য করার যুক্তি নেই।
যারা নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন, তারা ধরেই নিয়েছেন, তারা এবং এই নীতিমালা যাদের উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে তারা অনলাইন গণমাধ্যম সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা রাখেন। ফলে বিষয়টির সংজ্ঞা তারা নির্ধারণ করেননি। ফলে, জনমনে ধারণা তৈরি হয়েছে যে, হয়রানি করার উদ্দেশেই এটি অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। এই ধারণা যে অমূলক নয় তা গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে অতীতের বিভিন্ন সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের অভিজ্ঞতাই বলে দেয়।
অনলাইন গণমাধ্যমের আয়-ব্যয়
নীতিমালা যারা তৈরি করেছেন তারা ধরেই নিয়েছেন অনলাইন গণমাধ্যম একটি লাভজনক উদ্যোগ। নয়তো পত্রিকা-টেলিভিশনের মতো মিডিয়ার মতো রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এইখাতে লগ্নি করার জন্য লাখ লাখ টাকা নিয়ে বসে আছেন। ফলে, তাদের কাছে টাকা কোনো সমস্যা নয়। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা বলে, হাজার কোটি টাকার মালিকরাও তাদের গণমাধ্যম উদ্যোগকে লাভজনক দেখতে চায়। রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিপত্তি অর্জনের পাশাপাশি লাভের হাতিয়ার হতে না পারলে বিনিয়োগ সরিয়ে নেয়। আর অনলাইন গণমাধ্যম নিয়ে এদের বিশেষ আগ্রহ এ যাবত দেখা যায়নি। দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ উদ্যোগই তরুণ উদ্যোক্তাদের। বলতে গেলে, সবচেয়ে প্রথম শুরু হওয়া বিডিনিউজই এখন পর্যন্ত কোনো স্থায়ী বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞাপনের মারফত এই সাইটটি লাভজনক হতে পারেনি। এই সাইটটি তাদের এসএমএস ও মোবাইল নিউজ সার্ভিস ও আরও কিছু মাধ্যমে আয় করে। সে আয় থেকেই ওয়েবসাইটের ব্যয় বহন করে। শুধু ওয়েবসাইট ধরলে বিডিনিউজ একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ] বাকীদের কথা উল্লেখ না করলেও চলে।
এস্টাবলিশমেন্ট কষ্ট, বহু পাঠকের প্রয়োজন মেটাতে বড় সার্ভারের ব্যয় মেটাতে গিয়ে এসব অনলাইন বিশেষ লাভজনক হতে পারছে না। নীতিমালা প্রণয়নকারী সরকারি কর্মকর্তাদের জানা থাকা উচিত, বিনিয়োগকারীদের মতো বিজ্ঞাপনদাতারাও অনলাইনে বিশেষ আগ্রহী নয়। ফলে, রেজিস্ট্রেশন ও জামানতের জন্য ৭ লাখ টাকা ও প্রতিবছরের চাঁদা মেটানো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যই বাড়তি ব্যয়। ছোট উদ্যেক্তাদের জন্য এটি রীতিমতো অত্যাচারের শামিল। এই ব্যবস্থা আরোপের মাধ্যমে ছোট উদ্যোগগুলোর কণ্ঠরোধ করার পথ বের করা হয়েছে, তা স্পষ্ট।
শুধু বিনিয়োগ ও বিজ্ঞাপনের প্রশ্নই নয়। অনলাইন মাধ্যমে কেনাকাটা চালু করেও কিছুটা আয়ের পথ খোলা যেত। কিন্তু রক্ষণশীল ও পশ্চাদপদ মানসিকতার কারণে পে-পালের মতো সাইটগুলো এখানে খোলা হচ্ছে না। অনলাইনে আয়ের সকল পথই প্রকারান্তরে রুদ্ধ।
সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি যদি বাস্তবোচিত হতো তবে অনলাইন গণমাধ্যমের ওপর কর ও চাঁদা আরোপ না করে তারা বিশেষ উৎসাহ প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারতো। এক্ষেত্রে অনলাইন গণমাধ্যমের বিকাশ ত্বরান্বিত করার জন্য বাছাই করা ২০টি সাইটকে এককালীন ৭ লাখ ও প্রতিবছর ৫০ হাজার টাকা দেয়া যেত। সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়ার ব্যবস্থা হলে সেটিও কার্যকর হতো। আপনা থেকেই, অনলাইন গণমাধ্যমগুলো এতে সরকারে প্রতি নরম হয়ে যেত। কেননা, এক্ষেত্রে একমাত্র বড় আয়ের উপায় হতো সরকারের আনুকূল্য লাভ। কিন্তু তা না করে সরকার যা করতে চাইছে তা প্রকারান্তরে মুক্ততথ্যপ্রবাহের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে এবং এই একটি নীতিমালাই সরকারকে এন্টি ডিজিটাল ঘোষণা করার জন্য যথেষ্ট।
সরকার যদি কোনো ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন চালাতে চায় তবে এখন যে আইন আছে তাতেই সেই দমনপীড়ন, গ্রেফতার ইত্যাদি সম্ভব। সেখানে বাড়তি নীতিমালা কী উপকার করবে তা বোধগম্য নয়।
টেকনোলজি বোধ
বস্তুত, অনলাইন গণমাধ্যমের রেজিস্ট্রেশনের আইডিয়াটাই টেকনোলজি নির্বোধদের প্রস্তাব। এমন উদ্ভট প্রস্তাব পৃথিবীর কোথাও উঠেছে বলে জানা নেই। কেউ ব্যবসা করতে চাইলে কোম্পানি খুলবে, ট্রেড লাইসেন্স করবে, শেয়ার ছাড়বে, আয়কর দেবে। কিন্তু অনলাইন সাইট চালানোর জন্য সরকারি রেজিস্ট্রেশন? এটা উদ্ভট ও প্রয়োগ অযোগ্য। কেননা, এই নীতিমালা অনুসারে সরকার বাংলাদেশে সম্প্রচারিত সকল গণমাধ্যমের ওপর চাঁদা বসাতে পারে। সেটা কি তারা করতে যাচ্ছে?
বাংলাদেশের বাইরে যদি কোনো অবাংলাদেশি মালিকানাধীন বাংলা সাইট বা বাংলাদেশ বিষয়ে ইংরেজি সাইট পরিচালনা করেন তবে সরকার কী করবে? কোনো প্রবাসী যদি কানাডা, লন্ডন বা নিউ ইয়র্কে বসে সাইট চালান তবে সরকার তার কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা কীভাবে আদায় করবে? এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হলে বিদেশ থেকে পরিচালিত বাংলা সাইটগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা প্রকারান্তরে বাড়বে। এমনকি ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট ও ছোট নিউজ সাইটের বদলে বড় কর্পোরেট ব্লগগুলোর ওপর নির্ভর করতে হবে।
যারা নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছেন তাদের টেকনোলজি বিষয়ে জ্ঞান কেমন তা নিয়ে সন্দেহ করা যায় সহজেই। তাদের মতে, স্থানীয় কোম্পানির সার্ভার ব্যবহার করে সাইট পরিচালনা করা সম্ভব। বিটিআরসি একটি নির্ভরযোগ্য ডোমেইন সেবাই চালু করতে পারেনি সেখানে সার্ভার তো দূরের কথা। বাংলাদেশে বিটিআরসি যে ডটকম.বিডি ডোমেইন সার্ভিস দেয় তার মান এত খারাপ যে এটি পারতপক্ষে কেউ ব্যবহার করতে চায় না। সার্ভারের ক্ষেত্রে বড় ব্যয় করেও মার্কিন কোম্পানিগুলো থেকে অনেক সময়ই পর্যাপ্ত সেবা পাওয়া যায় না। সেখানে দেশি সার্ভার ব্যবহারের প্রস্তাব মামাবাড়ির আবদার ছাড়া আর কী হতে পারে।
কতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন হলে, সাইটে লিংক দেওয়া অবৈধ ঘোষণা করা যায় তা বোধগম্য নয়।
নকলনবিশি
সংবাদমাধ্যম জানায়, `কমিউনিটি রেডিওর নীতিমালাকে ভিত্তি ধরে অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে বলে জানান তথ্য সচিব`। বস্তুত, এটা স্রেফ কপিপেস্ট। সোজা কথায়, প্রস্তাবিত নীতিমালায় মাথা মোটা আমলারা ‘রেডিও’র জায়গায় ‘অনলাইন গণমাধ্যম’ বসানো ছাড়া আর কোনো কাজ করেছেন বলে মনে হয় না।
এর আগে বেসরকারি টেলিভিশনের জন্য এমন একটি ‘নকলনবিশি-নীতিমালা’ করতে গিয়ে তথ্যমন্ত্রণালয় হাসির খোরাক হয়েছিল। সে নীতিমালাটির দেখা ইদানিং পাওয়া যায় না। এবার আরেকটি নকলনবিশি নীতিমালা তৈরি করে নতুন হাস্যরস তৈরি করেছে তথ্যমন্ত্রণালয়। যে ‘নীতিমালা’ ধরে এ ‘নীতিমালা’ তৈরি করা হয়েছে সেটিও ভাল নীতিমালা নয়। এই নীতিমালার কারণে কমিউনিটি রেডিও বিকশিত হতে পারেনি। ব্যর্থ হয়েছে। এমন নীতিমালার কারণে বেসরকারি রেডিওগুলো ভাল করতে পারছে না। এমনকি টিভিগুলোও এ ধরনের নীতির কারণে স্বাধীন গণমাধ্যম হিসেবে বিকশিত হতে পারছে না। তবে অনলাইন গণমাধ্যম বিষয়ে নকলনবিশী-নীতিমালা হবে আত্মহত্যার শামিল।
ডিজিটাল বাংলাদেশ?
সরকার কথার কথা হিসেবেও যদি ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে থাকে তবে তাদের দায়িত্ব হবে, এ ধরনের নীতিমালা বালিশের নিচে দিয়ে ঘুমানো। তাতে দেশের অনেক উপকার হবে। কিন্তু নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে গেলে, দেশের তো ক্ষতি হবেই। আওয়ামী লীগেরও ক্ষতি হবে। সবাই, সেই বাকশালের কথা বলবে। কেননা এই নীতি প্রণয়ন হলে চার-পাঁচটি বাদে সব অনলাইন গণমাধ্যম বন্ধ করে দিতে হবে।
একটা প্রশ্ন
অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু একটা প্রশ্ন করতেই হয়। এই নীতিমালা অনুসারে রেজিস্ট্রেশন না করলে কী হবে তা বলা নাই। সে উত্তরটা কিন্তু জানা থাকা আমাদের জন্য জরুরি।